মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১২

কোরবানির মাসলা-মাসায়েল মু ফ তি মু হা ম্ম দ ফ য় জু ল্লা হ


 প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ-স্বাভাবিক, মুকীম এবং সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্যের সম্পদের মালিক হলে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর কোরবানি ওয়াজিবনিত্য অপরিহার্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘর, বাড়ি, আসবাবপত্র এবং ব্যবসায়ী পণ্যও এই হিসাবের অন্তর্ভুক্তকোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই সম্পদের উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া বা ব্যবসায়ী পণ্য হওয়াও আবশ্যক নয়
যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানির শেষ দিনেও উপরোক্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায়, তবে তার উপরও কোরবানি ওয়াজিবতবে শিশু ও উন্মাদ উল্লিখিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না
কোরবানি ওয়াজিব না হলে ঋণ করে কোরবানি করা উচিত নয়
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উচিত কোরবানি না করে ঋণ পরিশোধ করার চিন্তা করাতবে এমন ব্যক্তি কোরবানি করলে সাওয়াব লাভ করবে
তালেবে ইলমের জন্য নফল কোরবানি অপেক্ষা দ্বিনী কিতাব ক্রয় করা উত্তম
লৌকিকতা ও লোকলজ্জার কারণে কোরবানি করা বৈধ নয়
একটি পরিবারের পক্ষ থেকে শুধু এক অংশ কোরবানি করা যথেষ্ট নয়পরিবারের সব সদস্যের উপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকলে, তবে প্রত্যেকের কোরবানি করা আবশ্যক
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর যাকাত, সাদকায়ে ফিতর যেমন প্রতি বছর বাধ্যতামূলক, অনুরূপভাবে এমন ব্যক্তির উপর প্রতি বছর কোরবানি করাও ওয়াজিব
নিজের ওয়াজিব কোরবানি আদায় না করে জীবিত বা মৃত পিতা-মাতার জন্য কোরবানি করলে তবে সেই কোরবানি ওই ব্যক্তির পক্ষ থেকেই আদায় হবেপিতা-মাতা এর সওয়াবও পাবে না
কোরবানি ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যিনি অতীতে কোরবানি করতে পারেননি তবে তিনি তার উপর যত বছর কোরবানি ওয়াজিব ছিল এর হিসাব করে প্রত্যেক কোরবানির বিনিময়ে সমপরিমাণ কোরবানির মূল্য সাদ্কা করে দেবেন
আল্লাহতাআলা যাকে সম্পদ দান করেছেন তার উচিত নিজ কোরবানি আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, নবীজী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, উম্মাহাতুল মুমিনীন, সাহাবায়ে কিরাম এবং অন্যান্য আল্লাহর ওলীদের জন্যও কোরবানি করা
একাধিক ভাই মিলে কোরবানি করার ক্ষেত্রে এক সপ্তমাংশ যদি সম্মিলিতভাবে পিতা অথবা মাতার জন্য কোরবানি করে তবে এদের কারও কোরবানি বৈধ হবে নাতবে হ্যাঁ, যদি সব ভাই ওই অংশের টাকা একজনকে প্রদান করে তাকে ওই টাকার মালিক বানিয়ে দেয় এবং সে ওই টাকা দিয়ে মাতা কিংবা পিতার জন্য কোরবানি করলে তবে সবার কোরবানি বৈধ হবে
অংশীদারের ভিত্তিতে কোরবানি করার ক্ষেত্রে কোনো একজন অংশীদারের উদ্দেশ্য যদি গোশত বা গোশত বিক্রির থাকে তবে সব শরিকের কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবেঅতএব শরিকানা কোরবানির ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার ঠিক করে নেয়া বাঞ্চনীয়
কোরবানির জন্য ক্রয়কৃত পশু দিয়ে বিশেষ কোনো কারণে কোরবানি করতে না পারলে তবে ওই অবস্থায় পশুটি সদকা করে দিতে হবে

কোরবানির পশু
গরু, মহিষ, উট দিয়ে কোরবানি করার ক্ষেত্রে সাতজন মিলে কোরবানি দিতে পারবেকিন্তু শর্ত হচ্ছে কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে নাসেই সঙ্গে সবার নিয়ত কোরবানি অথবা আকিকার হতে হবেঅন্যথায় সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবেদুম্বা, বকরি এবং ভেড়া দিয়ে এক ব্যক্তির ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে
প্রথমোক্ত পশু একাধিক ব্যক্তি মিলেও কোরবানি দিতে পারবেআবার কোনো একক ব্যক্তিও অনুরূপ সম্পূর্ণ একটি পশু দিয়েও কোরবানি দিতে পারবেতবে শরিক যদি ৭ জনের অধিক হয়, তবে সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে
কোরবানির পশু কিছুদিন পালন করে তত্পর কোরবানি করা উত্তমসেই সঙ্গে কোরবানির পশুর দুধ দোহন করা বা এর পশম কাটা জায়েজ নেইযদি কেউ এমন করে তবে সেই পশম এবং দুধ অথবা সমপরিমাণ মূল্য অবশ্যই সদকা করে দিতে হবে
যদি পশুর চামড়া জ্বলে যাওয়ার কারণে জ্বলে যাওয়া স্থানে পশম না গজায় এবং যখম ইত্যাদি না থাকে এবং পূর্ণাঙ্গ দেহ যদি যথাযথভাবে থাকে, তবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ আছে
কোরবানির পশু যবেহ করার জন্য শোয়ানোর সময় পশুর কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে তা ধর্তব্য নয়সেই পশু দিয়ে কোরবানি করা যাবে
কোরবানির পশুর যদি শিং না ওঠে, অংশবিশেষ ভেঙে যায় অথবা শিংয়ের খোল খসে যায় তবে সেই পশু দিয়ে কোরবানি করা যাবেকিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙে যায় কিংবা উপড়ে যায় অথবা আঘাতের প্রভাব মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি সঠিক ও বৈধ হবে না
গর্ভবতী পশু দিয়ে কোরবানি করলে কোরবানি আদায় হয়ে যাবেকিন্তু জেনেশুনে কিছু দিনের মধ্যে প্রসব করবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি করা মাকরুহযদি এমন পশু দিয়ে কোরবানি করে তবে পেট থেকে যদি জীবিত বাছুর বের হয়, তবে সেটাও যবেহ করে দেবে এবং এর গোশত খাওয়াও বৈধ
দরিদ্র ব্যক্তির ক্রয়কৃত কোরবানির পশুর পা ভেঙে গেলে তবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় এমন দরিদ্র ব্যক্তি ওই পশুটি দিয়েই কোরবানি করতে পারবে
ভুলবশত, পরস্পরের পশু কোরবানি করে ফেললে তবে উভয়ের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে
ধনী, গরিব সবার জন্য কোরবানির পশু দ্বারা উপকৃত হওয়া মাকরুহ

কোরবানির সময়
ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নেইঈদের নামাজের পর কোরবানি আদায় করতে হবে
যদি কোরবানি দাতা নিজে কোনো কারণে ঈদের নামাজ পড়তে না পারে, তবে শহরের কোথাও যদি ঈদের নামাজ আদায় হয়ে যায় তবে ঈদের নামাজ আদায় করতে না পারলেও সে কোরবানি করতে পারবে
যদি শহরের কোনো একটি স্থানে ঈদের নামাজ হয়ে যায়, তবে শহরের অন্যত্র কোরবানি করা যাবে
জবেহ
কোরবানির পশু জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবরবলা আবশ্যক কোরবানির নিয়তের দুআ পড়া হোক বা না হোক এক্ষেত্রে শুধু কোরবানির নিয়ত করাই যথেষ্ট
কোরবানির পশু জবেহ করার সময় উচ্চস্বরে শরিকদের নাম উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেইতবে হ্যাঁ, জবেহ করার সময় জবেহকারী ব্যক্তি সব শরিকের পক্ষ থেকে কোরবানি করার কথা খেয়াল রাখবে
ইসলামে জবেহর ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত প্রযোজ্য। (এক) জবেহকারী মুসলমান হওয় (দুই) জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা। (তিন) শরয়ী পদ্ধতিতে গলা, শ্বাসনালী এবং রক্তের প্রবহমান রগ কেটে দেয়া
কোরবানির পশু জবেহ করার আগে তাকে পানাহার করানো উচিত
সহজভাবে কোরবানির পশুকে শোয়ানো উচিত
কিবলামুখী করে বাম পার্শ্বস্থ করে শোয়ানো উচিত
তিনটি পা বেঁধে ফেলা উচিত
ছুরি ধারালো হওয়া উচিত
ছুরি যদি ধার দিতে হয়, তবে পশুকে শোয়ানোর আগেই ধার দিয়ে নেবে এবং পশুর সামনে ধার না দেয়া উচিত
একটি পশু অন্য পশুর সামনে জবেহ করা মাকরুহ
জবেহ করার পর পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগে দেহ থেকে মাথা পৃথক করা এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ কর্তন করা ও চামড়া ছাড়ানো নিষেধ
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে মাসআলা অনুযায়ী কোরবানি করার তৌফিক দিন

             তাকবীরে তাশরীক তাওহীদের উজ্জীবন

মু হা ম্ম দ ত্ব হা হু সা ই ন দা নি শ
ইসলাম তাওহীদের ধর্মশিরকের পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত হয়ে তাওহীদের চেতনা ও বিশ্বাস মনে-প্রাণে লালন করা মুমিন জীবনের প্রধান শর্তজিলহজএর মতো মহিমান্বিত ও সম্মানিত মাসটির প্রায় প্রতিটি আমলের সঙ্গে এই তাওহীদি ঘোষণাকে জুড়ে দিয়ে মুমিন হৃদয়ে তাওহীদের শিক্ষাকে আরো শানিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছেহজের তালবিয়া, জামরায় কংকর নিক্ষেপ, ঈদগাহে গমনের পথে ঈদের খুতবা ও কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় ঘোষিত হয় তাওহীদে খালেসের বলিষ্ঠ উচ্চারণ
জিলহজের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে একটি অবশ্য করণীয় আমল হলো, তাকবিরে তাশরিকের আমলপ্রত্যেক মুসল্লির জন্য ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজ আদায় করে সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিবমহিলাদের জন্যও ফরজ নামাজের শেষে নিচু স্বরেএকবার করে তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব
তাকবিরে তাশরিকের জন্য হাদিস ও আছারে বিভিন্ন শব্দ উল্লিখিত হয়েছে তন্মধ্যে সর্বজনবিদিত উত্তম শব্দ হলো-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ
অনেককে তাকবিরে তাশরিকের উল্লিখিত শব্দগুলোর একটি পটভূমি উল্লেখ করতে দেখা যায়যখন হজরত জিবরাঈল (আ.) আসমান থেকে দুম্বা নিয়ে এসেছিলেন, তখন হজরত ইব্রাহীম (আ.)-কে প্রিয়পুত্র ইসমাঈলের গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত অবস্থায় দেখে হাঁক দিলেন, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবারওপরের দিকে তাকিয়ে হজরত ইব্রাহীম (আ.) জিবরাঈল (আ.)-কে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবারউভয়ের তাকবির শুনে ইসমাঈল (আ.) বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ
বলা হয়ে থাকে এই তিনজনের তাকবিরের সমষ্টি থেকে তাকবিরে তাশরিকের উত্পত্তি কোনো কোনো ফিকহের কিতাবে পটভূমির বর্ণনা থাকলেও এর কোনো দালিলিক ভিত্তি পাওয়া যায় নাফাতহুল কস্ফাদির প্রণেতা বিশিষ্ট ফকীহ্ আল্লামা ইবনুল হুমাম, ইবনে নুজাইম ও ইবনে আবেদীন শামী (রহ.) প্রমুখ ফকীহের অভিমত হলো, ‘এই কিস্সাটি প্রমাণিত নয়। (ফাতহুল কস্ফাদির ২/৪৯; আল বাহরুর রায়েক ২/১৬৫; রদ্দুল মুহ্তার ২/১৭৮)
এমনিভাবে হাফেজ যায়লায়ী, ইবনে হাজার আসকালানি ও কাসেম বিন কুতলুবুগাসহ বিখ্যাত মুহাদ্দিসরাও বলেছেন, ‘এই রকম কোনো বর্ণনা আমরা পাইনি। (নসবুর রায়া ১/২২৪, দিরায়াহ কিতাবে উল্লিখিত ঘটনা ছাড়াই উপরোক্ত তাকবিরের শব্দগুলোই শুধু বর্ণিত হয়েছেএখানে এই তাকবিরের সঙ্গে ওই ঘটনা বা পটভূমির ভিত্তি না থাকা থেকে এই তাকবির যে ওয়াজিব, এ ব্যাপারে কোনো সংশয়ের মধ্যে পড়া ঠিক হবে না
তবে এই দিনগুলোয় তাকবির ও যিকিরের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করার পটভূমি নিয়ে আল্লামা খাত্তাবী (রহ.)-এর কথাটি উল্লেখযোগ্যতিনি বলেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উত্সর্গ করতপ্রতি উত্তরে মুমিনদের আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবিরের মাধ্যমে তাওহীদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করেতারা বলেন, আল্লাহই একমাত্র ইলাহ্তাঁর কোন শরিক নেইতিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উত্সর্গ করা যাবে নাকারণ তা সুস্পষ্ট শিরক। -ফাতহুল বারী ২/৫৩৫
তাকবিরে তাশরিকের উল্লিখিত আমলের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু গাফিলতি দেখা যায়প্রথমত, মাসবুক ব্যক্তি ও একাকী নামাজ আদায়কারীদের এই আমল করতে দেখা যায় নাদ্বিতীয়ত, মহিলাদের ক্ষেত্রে এই গাফিলতি খুবই ব্যাপকঅনেক সময় স্মরণে থাকে নাসে জন্য মহিলারা একটি কাজ করতে পারেনঘরে নামাজ আদায়ের স্থানে একটি কাগজ লিখে ঝুলিয়ে রাখা, যাতে জায়নামাজে এলেই তা দৃষ্টিগোচর হয় এবং সহজে ওই তাকবিরের আমল করা যায়তৃতীয়ত, যে বড় অবহেলাটি প্রায় আমাদের সবার মাঝে দেখা যায় তা হলো, ঈদগাহে যাওয়ার পথে এবং পাঁচ দিনের ফরজ নামাজের পর এই তাকবির আমরা উচ্চারণ করি মনে মনে কিংবা খুবই নিচু স্বরেঅথচ সাহাবায়ে কেরামের তাকবির ধ্বনিতে পুরো আশপাশ কেঁপে উঠতএভাবে চারদিকে মুখরিত হয়ে উঠত তাওহীদ-তাকবিরের বিজয় ধ্বনিতাকবিরে তাশরিক উচ্চৈঃস্বরে বলার অন্যতম হিকমত হলো, ইসলামের একত্ববাদ ও তাওহীদের বলিষ্ঠ ঘোষণা দেয়া, আল্লাহর মনোনীত ধর্মের শৌর্য-বীর্যের উচ্চকিত প্রকাশ করা

 

   ঈদুল আজহা : পুণ্য ও ত্যাগের উত্সব

                            ড. আ ফ ম খা লি দ হো সে ন
মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীমউত্সব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সঙ্গে সম্পৃক্তইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথাতাই ঈদ শুধু আনন্দের উত্স নয় বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে বৈশিষ্ট্যসমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণএলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হনএতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠেইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়পরস্পরর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়ধনী গরিবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় নাঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়এর ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকেঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসেঈদুল আজহার যে কোরবানি দেয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্ত-মাংস কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় নাশুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কেঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন
কোরবানি আরবি শব্দ, আরবিতে কুরবানুন কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত যার অর্থ নৈকট্য, উত্সর্গ, বিসর্জন ও ত্যাগ ইত্যাদিকোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্যশরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এই তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হলো কোরবানিত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উত্সর্গ করাই কোরবানির তাত্পর্য প্রচলিত কোরবানি হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর অপূর্ব আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ হাদিসে বর্ণিত আছে : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কোরবানি কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নাততারা বললেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে? তিনি বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছেতাঁরা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, বকরীর পশমেও কি তাই? জবাবে তিনি বললেন, বকরীর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি আছেমুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.) থেকে অব্যাহতভাবে চলে আসছে কোরবানির ঐতিহ্যধারা
নেক আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ আমলএ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় কোরবানি করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি তিনি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেনমহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে
কোরবানীর এ ফজিলত হাসিল করতে হলে প্রয়োজন ওই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা ও ঐকান্তিকতা যা নিয়ে কোরবানি করেছিলেন আল্লাহর খলীল হজরত ইব্রাহীম (আ.) কেবল গোশত ও রক্তের নাম কোরবানি নয়বরং আল্লাহর রাহে নিজের সম্পদের একটি অংশ বিলিয়ে দেয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কোরবানিগোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে নাকেননা আল্লাহতায়ালার কাছে গোশত ও রক্তের কোনো মূল্য নেইমূল্য আছে কেবল তাকওয়া, পরহেজগারী ও ইখলাসের আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে কখনও জবেহকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছবে না, পৌঁছবে কেবল তাকওয়া (সূরা হজ : ৩)
অতএব, আমাদের একান্ত কর্তব্য, খাঁটি নিয়ত সহকারে কোরবানি করা এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জন করানিজেদের আনন্দে অন্যদের শরিক করা ঈদুল আজহার শিক্ষা কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয়-স্বজনকে প্রদান এবং তৃতীয় অংশ সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া ইসলামের বিধানকোরবানিকৃত পশুর চামড়া অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য প্রদান করলে দ্বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়এক দুঃখী মানুষের সাহায্য দ্বিতীয় দ্বীনি শিক্ষার বিকাশ প্রকৃতপক্ষে কোরবানিদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না বরং সে তো ছুরি চালায় সব প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে এটিই কোরবানির মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তিএ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কোরবানি করা হয় তা হজরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর সুন্নাত নয়, এটা এক রসম তথা প্রথামাত্রএতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু ওই তাকওয়া হাসিল হয় না, যা কোরবানির প্রাণশক্তি
আকিল, বালিগ, মুকীম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) ব্যক্তিই ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিবকোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মতো সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়বরং যে অবস্থায় সাদকায়ে ফেতর ওয়াজিব হয় ওই অবস্থায় কোরবানিও ওয়াজিব হবে
ঈদ মানুষের জীবনে আসে পরম আনন্দ নিয়েআর পেছনে থাকে তার তাত্পর্যঈদের বৈশিষ্ট্য থেকে এই তাত্পর্য ঈদ উত্সব পালনের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবেঈদের সীমাহীন আনন্দ উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যে নিজেকে নিবেদিত করা আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ত্যাগের, ভ্রাতৃত্বের, সম্প্রীতির ও সহমর্মিতার মহান আদর্শ অনুধাবন করতে হবেতাহলে ঈদ উত্সব পালনের সার্থকতা প্রমাণিত হবেকোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের পাশাপাশি মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন, চিন্তার স্বচ্ছতা, ত্যাগের মহিমা, হৃদয়ের উদারতাসবকিছু মিলে কোরবানির এক স্মরণীয় অধ্যায়বস্তুত পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাশবিকশক্তি তথা কু-প্রবৃত্তিকেও কোরবানি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হতে হবে
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

কোরবানির ক্ষমতা : ক্ষমতার কোরবানি

                        মো হা ম্ম দ র ফি ক উ জ্জা মা ন
কোরবানির সূত্রপাতের ঘটনাটি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেইঘটনাটি জানেন না এমন মুসলমান তো পাওয়া যাবেই নাএমনকি অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও অনেকেই জানেনআমার কাছে ঘটনাটিই প্রধান নয়প্রধান হলো এর উদ্দেশ্যহজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তানকে জবাই করা এবং অলৌকিকভাবে সন্তানের পরিবর্তে পশু জবাই হয়ে যাওয়া থেকেই এ প্রথার শুরুএ পশু কোরবানি প্রকৃত অর্থে একটি প্রতীকী বিষয়কারণ কোরবানি করা পশুর কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে নাপৌঁছায় কোরবানিদাতার নিয়ত ও উদ্দেশ্যউদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান হয়, তবে তার যে ফল হবেউদ্দেশ্য লোক দেখানো হলে তার ফল নিশ্চয় বিপরীত হবে এমনকি জাঁকিয়ে মাংস ভক্ষণও কোরবানির উদ্দেশ্য নয়কোরবানির প্রধান উদ্দেশ্যই ত্যাগকিন্তু এ ভোগবাদী বিশ্বের যে দানবীয় প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে, তাতে বিশেষ করে ধনবান এবং ক্ষমতাবান মানুষরা মল-মূত্র ছাড়া আর কিছু ত্যাগ করার কথা প্রায় ভুলেই গেছেনা, সম্ভবত কথাটা সম্পূর্ণ হলো না বিশেষত ক্ষমতাবানরা সবচেয়ে বড় যেটা ত্যাগ করেছেন সেটা সত্যএকই সঙ্গে ধৈর্য-সংযম ন্যায়নীতি-পরার্থ এগুলোও ত্যাগ করেছেন
সম্ভবত আবারও ভুল বললামপরার্থ ত্যাগ করলে ভারতের উপকারের জন্য বাংলাদেশের স্বার্থের গলায় পাড়া দিয়ে পুলকিত হয়ে বলেন কী করে যে বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেশবানাবেন, যা চলছে তাতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে ভারতের ট্রানজিট দেশ বানিয়ে ছাড়বেন তারাএ জন্য প্রথমেই তাদের যা ত্যাগ করতে হয়েছে, তাহলো সত্যজনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সত্য ত্যাগ না করে তাদের কোনো উপায়ও ছিল না সেই ধোঁকাবাজির শব্দগুলো ছিলকরিডোরে রাস্তা ভাড়া দিয়ে, বন্দর ভাড়া দিয়ে হাজার কোটি টাকার বন্যায় ভাসবে বাংলাদেশগত ৩০ অক্টোবর যশোর থেকে প্রকাশিতলোকসমাজপত্রিকার ১৫ বছরে পদার্পণ সংখ্যায় এ সম্পর্কে লিখেছিলাম, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা আসবে, বাংলাদেশ টাকার জোয়ারে ভাসবে, ওদিকে মনমোহন-প্রণব বাবুরা কাশবে, সেই কফ বাংলাদেশের গলায় ফাঁসবে, দাদারা কাঁচকলা দেখিয়ে হাসবেএর প্রথম অংশ এ দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন সময় বলেছেন, ওই টাকার জোয়ারে ভাসবেপর্যন্তশেষের অংশ চেপে গিয়েছিলেনপ্রথম অংশটুকু যে সত্যকে কোরবানি দেয়া, তা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে
গত ৩ নভেম্বর আমার দেশ পত্রিকার ৭-এর পাতায় আঁকা কার্টুনটিতে কাঁচকলা দেখিয়ে হাসার দৃশ্যটি ফুটে উঠেছেএর আগেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেশেছে এবং সেই কফ এসে যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের গলায় ফেঁসেছে, তাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ঘোষণায়তিনি বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে শুল্ক নয়, কিছু একটা নেবএই কিছু একটা টা কী? আমরা এ দেশের জনসাধারণ তা জানি নাতবে সেটা যে ওই কাঁচকলা দর্শনের বেশি কিছু নয়তার অভিজ্ঞতা তো আমাদের এরই মধ্যে হয়ে গেছে
কোরবানির কথা বলছিলামবাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে এভাবে কোরবানি দেয়ায় জনগণ এবং মহাপ্রভু আল্লাহ খুশি না হলেও অন্য প্রভুরা অবশ্য খুবই খুশি হবেন বাংলাদেশকে এ কোরবানি দিতে বাধ্য করার জন্য বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি নামক প্রভুরা যে লবিং করেছিল, তার ফললাভে তারা তো খুশি হবেই, সঙ্গে খুশি মহাখুশি ভারত এবং সম্ভবত ভারতকে খুশি রাখাই স্বর্গলাভ তথা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার একমাত্র উপায়
ভোগবাদ মানুষেরা মনুষ্যত্বকে হত্যা করেঅনৈতিকতা নামক এক পশুর জন্ম দেয় ধনবান-ক্ষমতাবানদের শক্তি যেহেতু বেশি, তাই তার পাশবিকতার প্রকাশও অতিশয় নগ্নভূমিদখল, নদীদখল, শ্রমিকের ঘাম-রক্তদখল, দরিদ্রের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি দখল থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চান্দাবাজি, তোলাবাজি, লুটপাট, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, হামলা, লাঠি-রড, তলোয়ার, চাপাতি আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ ব্যবহার ইত্যাদি কামড়াকামড়ি হয়ে ওঠে নৈমিত্তিককামড়াকামড়ি শব্দটা ব্যবহার করতেই হলোকারণ কিছু ইতরপ্রাণী আছে যারা নিজ দল, নিজ গোত্রের মধ্যেও এ আচরণে অভ্যস্তযাদের ভেতরের এ পশুপ্রবৃত্তি হিংস্র নখদন্ত মেলে ক্রিয়াশীলতাদের, বাইরে পশু কোরবানি(!) করাটা কিছু প্রাণী হত্যার চেয়ে বেশি কোনো মর্যাদার নয় বলেই আমার বিশ্বাসযারা উদয়াস্ত পরিশ্রমকারী কৃষকের ঘামের ফসল নামমত্র মূল্যে কিনে কৃষককে অনাহারি রাখেতাদের কোরবানির(!) রক্তে আমি কৃষকের রক্ত দেখতে পাইশ্রমিকের রক্ত দেখতে পাই শ্রমিক ঠকানো মালিকের কোরবানিতে(!), ভূমিহীনের রক্ত দেখি ভূমিদস্যুর কোরবানিতে(!), মজুরের শ্রম শোষণকারী মহাজনের কোরবানি(!)-তে প্রবাহিত হয় মজুরের রক্ত একইভাবে পশুপ্রবৃত্তির অন্য কাজবৃন্দের কোরবানি(!)-তে মিশে থাকে শোষিত প্রতারিত জবরদস্তিতে পরাজিত, বঞ্চিত, অসহায় মানুষের রক্তক্ষমতার অপব্যবহারকারীর কোরবানিতে(!) মিশে থাকে আশাহতবিশ্বাস করে প্রতারিত জনতার রক্ত
সরকার সবসময় দাবি করে, তরা জনগণের ভোটে নির্বাচিতরাষ্ট্রের মালিক যদি জনগণ হয়ে থাকেনএবং সরকার যদি হয় জনগণের প্রতিনিধি, তাহলে রাষ্ট্রের সব বিষয় সম্পূর্ণ খোলাখুলিভাবে জানার অধিকার তো জনগণেরম্যান্ডেট পাওয়া মানে জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে যা খুশি তাই করার অধিকার নয়বিশেষ করে রাষ্ট্র যখন অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করে তা সম্পূর্ণভাবে জনগণকে অবহিত করেই করা উচিতএ বিষয়ে কোনো আড়াল-অস্পষ্টতা তো জনগণের স্বার্থেই হতে পারে নাএর মধ্যে জনস্বার্থ কোরবানি দিয়ে গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের অপকৌশলই প্রমাণিত হয়এ জনস্বার্থ বলিদাতাদের কোরবানি(!)-তে মিশে থাকে গোটা জাতির রক্তএ কথাটি আমি শুধু বর্তমান সরকার সম্পর্কেই বলছি তা নয়এর আগেও আমরা বিভিন্ন উদ্যোগে জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেছি
এ দেশে যখন ট্যাক্সিক্যাবের প্রচলন হলো, তখন হঠাত্ করে ঘোষণা দেয়া হলো, ট্যাক্সিক্যাব অবশ্যই নতুন গাড়ি হতে হবে, রিকন্ডিশনড গাড়ি চলবে নাএর সুযোগ নিয়ে ভারতীয় মারুতি কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করে নিলযেসব গাড়ি ও দেশে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়, বাংলাদেশের ট্যাক্সিক্যাব ব্যবসায়ীদের তা কিনতে হলো প্রায় চারগুণ বেশি মূল্যেতখন ওই দামেই যেসব জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ি পাওয়া যেততার তুলনায় ভারতীয় ওই গাড়িগুলোকে ছ্যাকড়াছাড়া আর কিছুই বলা যায় নাসেসব গাড়ির অধিকাংশই এখন ভাগাড়ে গেছেপথে বসেছে অনেক ব্যবসায়ীঅথচ তার চেয়ে বহু পূর্বেকার জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ি এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ দেশের পথে পথেভারতীয় ওইসব গাড়ির চেয়ে জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ি যে বহুগুণে ভালো এবং মজবুত, তা যে কোনো মানুষই জানেনকর্তৃপক্ষও নিশ্চয় জানতেনতারপরও এ ব্যবস্থা নেয়ার পেছনে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে গোপন লেনদেনের ব্যাপার যুক্ত ছিল এবং তাতে গোষ্ঠী বা ব্যক্তি লাভবান হয়েছে এ কথা যে কোনো সচেতন মানুষই বোঝেনএ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কোরবানি(!)-তে কি প্রতারিত ব্যবসায়ী ও জনগণের রক্ত মিশে নেই?
প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, কুত্সা, মিথ্যাচার ও মিথ্যা দোষারোপ, আত্মপ্রচারএসবই অনৈতিকতা ও কুপ্রবৃত্তিজাত পশুত্বের প্রকটিত রূপএ পশুত্ব ভেতরে বর্তমান রেখে, বাইরের পশু কোরবানিও অকারণ প্রাণী হত্যার সামিল কথাগুলো শুধু ক্ষমতাধর নয়, ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের জন্যও সমান প্রযোজ্য কাগজে-কলমে আমাদের দেশের চল্লিশ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বলে প্রচারিত হলেও বাস্তবে তা পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি হবেঅথচ স্বাধীনতা লাভের সময় মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভিন্নসেই প্রত্যাশা পূরণে যারা ব্যর্থ হয়েছেন এবং যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে মানুষ দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়েছেন, তাদের কোরবানিতেও হতদরিদ্র মানুষের দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি প্রতিফলিত হয় না? কিছু মানুষের ভোগলিপ্সা ও ক্ষমতালিপ্সা জনসাধারণকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছেঅথচ গণমানুষের ক্ষমতায়ন ছাড়া স্বাধীনতা শব্দটাই অর্থহীনক্ষমতার কেন্দ্র ও তার আশপাশে যারা আছেন তারা কী এ কোরবানির ঈদে শপথ নিয়ে এমন কথা বলতে পারবেন যে
চাই মানুষের প্রতি মমতা
চাই মানুষে মানুষে সমতা
সমতা মমতা মিলিয়ে গড়বো
গণমানুষের ক্ষমতা
অবশ্য জনতার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যারাই সংসদে যানতারা যে যার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ নিয়েই তবে সেখানে আসন গ্রহণ করেনযে শপথ তারা নেনতা কি রক্ষা করেন? যদি তার কিয়দংশও রক্ষা করতেন, তাহলে এ দেশের ওপর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী প্রভুদের খবরদারি থাকত নাথাকত না স্বদেশী লুটেরাদের লুণ্ঠন, সামাজিক বিভাজন, দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন, দৃষ্টিকটু দলবাজি, প্রতিপক্ষের প্রতি জান্তব শত্রুভাবাপন্নতা, নোংরা পক্ষপাত এবং গণমানুষকে শোষণ-নিষ্পেষনের ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়াক্ষমতা যাদের আছেতারা সবাই তথাকথিত কোরবানি দেবেন; কিন্তু ক্ষমতার নির্মম অপপ্রয়োগের প্রবৃত্তি নামক পশুকে কোরবানি দিতে পারবেন কি কেউ?

           প্রবাসে ঈদ : কোরবানির গরুর দেখা মেলে না

                           ব্যা রি স্টা র তা রে ক চৌ ধু রী
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো যুক্তরাজ্যেও প্রবাসী মুসলমানরা ঈদ পালন করে থাকেনএখানকার ঈদ বাংলাদেশের মতো তেমন আড়ম্বরপূর্ণ হয় নাঅনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা পালন মাত্রতবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লন্ডনে খোলা পার্কে ঈদের জামাত আয়োজন করায় অনেকটা দেশের ঈদগাহে নামাজ পড়ার অনুভূতি ও আনন্দ লাভ করেন অনেকেদিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি মসজিদেই তিন থেকে চারটি জামাতে ঈদের নামাজ আদায় হয়বর্তমানে পূর্ব লন্ডনে স্টেপনিগ্রিন পার্ক ও ইলফোর্ডে ভ্যালেন্টাইনস পার্কে খোলা আকাশের নিচে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়ভ্যালেন্টাইনস পার্কে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য বিশাল এলাকায় পর্দা টাঙিয়ে আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রয়েছেতবে ইস্ট লন্ডন মসজিদে সব সময়ই মহিলাদের নামাজের পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে
ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের মতো এখানে প্রধানমন্ত্রী মুসলিম কমিউনিটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়ে থাকেনব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও শুভেচ্ছা বাণী প্রদান করেনঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে মুসলিম কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ও সাংবাদিকদের সম্মানে নৈশভোজেরও আয়োজন করে থাকেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে
এবার আসা যাক কোরবানির কথায়বিলেতে প্রকাশ্যে পশু জবাই করা নিষিদ্ধতবে নির্ধারিত এলাকায় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান থেকে কোরবানি দেয়া যায় কোরবানি দিতে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সেটা হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে অনেক এশিয়ান বা বাংলাদেশি গ্রোসারি ঈদের সময় কোরবানির জন্য আগ্রহীদের নাম সংগ্রহ করে থাকেঈদের প্রায় একমাস আগে থেকে দোকানে দোকানে দেখতে পাবেন সাইনবোর্ড ঝুলানো রয়েছে এখানে কোরবানির অর্ডার নেয়া হচ্ছেএর অর্থ হচ্ছেএখানে নাম লিখিয়ে প্রতি নামের বিপরীতে অর্থ দিয়ে যাবেনপ্রতি অংশ বা পোরশন-এর জন্য দোকানভেদে দামের পার্থক্য রয়েছেকেউ হয়তো অংশ প্রতি চলতি বছর ২০০ পাউন্ড থেকে শুরু করে, যা ২৩০ বা ২৪০ পাউন্ডে গিয়ে ঠেকছেএই মূল্য একটি গরুর ৭ ভাগের এক অংশেরগরু ছাড়া বিলেতে ছাগলের পরিবর্তে ভেড়ি কোরবানি দেয়া হয়ে থাকেভেড়ি প্রতি এবার মূল্য ১০০ পাউন্ড থেকে ১৩০ পাউন্ড ধরা হচ্ছে আর প্রতি গরুর মূল্য ধরা হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ পাউন্ডগরুর এক অংশ কিনলে এক রকম দাম, আর পুরো গরু হলে আরেক ধরনের দাম
স্থানীয় দোকানিরা গ্রাহকদের কাছ থেকে অংশ প্রতি বেশি পয়সা নিয়ে কম দামে গরু বা ভেড়ি কিনে লাভ করেবেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরুর বা ভেড়ির মাংস ঈদের পরের দিন গ্রাহকদের সরবরাহ করা হয়কেউ বাড়ি বাড়ি ডেলিভারি দেয়আবার কোনো ক্ষেত্রে দোকান থেকে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করতে হয়কোরবানি আবার যে কেউ দিতে পারে নাকেবল লাইসেন্সধারী স্লটার হাউস বা কসাইখানায় জবাই করা সম্ভব কসাইখানাও ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদিত হালাল ফুড অথরিটির লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হয়১৯৯৪ সাল থেকে হালাল ফুড অথরিটি কাজ করে যাচ্ছে
বিলেতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংস্থা পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে কোরবানির অর্থ মুসলমানদের কাছ থেকে উত্তোলন করে থাকে
বিলেতে বাংলাদেশের মতো ঈদের দিন আরেকটি স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে কবর জিয়ারাত পূর্ব লন্ডনে ফরেস্টগেট কবরস্থানে এবং হ্যানল্ট এলাকায় পিস অব হ্যাভেনকবরস্থানে লোকজন ব্যাপকহারে ভিড় করে থাকে উদ্দেশ্য : নিকটাত্মীয় যারা ইন্তেকাল করেছেন, আল্লাহর দরবারে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনাঈদের দিন কোনো সরকারি ছুটি নেইনামাজ শেষে লোকজন যার যার কাজে চলে যায়তবে ব্রিটেনে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় সরকারি অফিসগুলোতে মুসলমানরা ঈদের ছুটি চাইলে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে থাকেবিলেতে তরুণদের মধ্যে ঈদ অনেকটা মোবাইল মেসেজ বা ফেসবুক শুভেচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে উঠেছেতবে বাংলাদেশ থেকে নতুন আগত ইমিগ্র্যান্টরাই বিদেশে দেশের ঈদ আনন্দ বাড়িয়ে রেখেছে

 

       নোমান সাহেবের কোরবানি

                                 আ হ সা ন হা বী ব
নোমান সাহেবের ব্যবসার অবস্থা মোটেই ভালো যাচ্ছে নাএ বছর কোরবানি দিতে পারবেন বলে মনে হয় নাকিন্তু কোরবানি না দিলে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীত্রু (প্রতিবেশী+শত্রু) ছদরুল সাহেবের কাছেও ইজ্জত ধরে রাখা সত্যি কঠিন হবেতার ফাজিল শ্যালক (যে তার বাসায় থেকেই পড়াশোনা করে প্রতি বছর ডিগ্রি ফেল করে) অবশ্য একটা বুদ্ধি দিয়েছে খারাপ না, ঈদের আগের দিন একটা প্রমাণ-সাইজ গরুর চামড়া কিনে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে হবে, তারপর ঈদের দিন সকালে টাইমমত বাইরে ঝুলিয়ে দিলেই হলোসবাই ভাববে এই বাড়িতে সকাল সকাল কোরবানি হয়ে গেছে!
কিন্তু পরদিন তার প্রতিবেশীত্রুছদরুল সাহেব যখন এসে বললেন, ‘ভাইজান গরু তো কিনলাম, দেখেন তো কেমন হলো?’
তখন গরু দেখতে এসে টাস্কি খেয়ে গেলেন নোমান সাহেবচট করে তার মাথায় যেটা এলো, সে হচ্ছে এই গরুকে ডিফিট দেয়ার একটাই বুদ্ধি, উট যদি কেনা যায়সৌদি আরবের উট...
- তুমি উট কিনবে?
- না না, মানে...
- মানে আবার কী? দেখো অ্যানথ্রাক্সের একটা ব্যাপার আছে, তার ওপর তোমার ব্যবসার যা অবস্থা, কোরবানির চিন্তা এবার বাদ দাও
- কিন্তু ছদরুল সাহেবের কাছে মান-ইজ্জত... নোমান সাহেব স্ত্রীর কাছে মিন মিন করেন
- রাখো তোমার মান-ইজ্জত... এসব খেলা অনেক হয়েছেআর নয়
স্ত্রী ঝঙ্কার তুলে চলে যান রান্নাঘরের দিকেআর নোমান সাহেবের মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে উটের চিন্তাচিরশত্রু ছদরুল সাহেব তার চোখের সামনে রাজসিক গরু কোরবানি দেবে আর তিনি... তিনি আর ভাবতে পারেন নাআর তখনই তার ভাবনার মধ্যে আচমকা একটা বিদ্যুত্ ঝলকের মতো কিছু ঘটেতার মনে পড়ে আবদুল হকের কথাযেই আবদুল হককে তিনি এক সময় ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা করে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেনআচ্ছা তাকে যদি বলা যায়... একটা উট কি সে পাঠাতে পারে না জাহাজে করে? সে তো এখন বিরাট ব্যবসায়ী, অনেক কিছুই নাকি জাহাজে করে পাঠায় প্রতি সপ্তাহে! আর তিনি কম করেছেন তার জন্য? তার বিনিময়ে সামান্য একটা উট!
যেই কথা সেই কাজ... তিনি আবদুল হক কে একটা এসএমএস করে দিলেন চোখ বন্ধ করেইফ পসিবল সেন্ড ক্যামেল বাই শিপ
পরদিনই পাল্টা এসএমএস এলনো প্রবলেম, ক্যামেল গোয়িং বাই ডিএইচএল
ডিএইচএল এ? নোমান সাহেব হকচকিয়ে যানআজকাল ডিএইচএলেও উট পাঠানো সম্ভব?
তবে বিষয়টা তিনি কাউকে জানালেন নাগোপনই রাখলেনআগে তো আসুক উট তারপর দেখা যাবেতবে একটা মই কিনে ফেললেন (তিনি শুনেছেন উটকে কোরবানি করতে হলে উটকে শোয়ানো যায় নাওপর থেকেই ছুরি চালিয়ে কতল করতে হয়, তাই মই কেনা)
- হঠাত্ মই কেন? স্ত্রী জানতে চান
- এ্যাঁ...ইয়ে সস্তায় পেলাম তাইনোমান সাহেব আমতা আমতা করে কাটান দেন
কিন্তু ফাজিল শালা রসিকতা করতে ছাড়ে নাদুলাভাই মই যখন কিনেছেন সাপও কেনা হোক
- সাপ কেন? বিরক্ত দুলাভাই ভ্রূ কোঁচকান
- বাহ শালা দুলাভাইয়ে বেশ বাস্তবধর্মী সাপ-লুডু খেলা যাবে
ঈদের দুদিন আগে নোমান সাহেবের ডিওএইচএসের ভাড়া বাসার সামনে ডিএইচএলের গাড়ি এসে হাজিরপুলকিত নোমান সাহেব ছুটে যানতবে কি সত্যি সত্যি তার উট চলে এল?
- আপনি মি. নোমান?
- জি জি
- সৌদি আরব থেকে আপনার নামে ...
- জি জি, বুঝতে পেরেছি
- এখানে সই করুনদুই-তিন জায়গায় সই করতে হলো নোমান সাহেবকেতারপর তারা একটা ছোটখাটো বাক্স নোমান সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল
বাক্স? তবে কি আবদুল হক উট কোরবানি দিয়ে বাক্সে করে গোস্ত পাঠিয়ে দিয়েছে? হায়! হায়!!
- কিসের বাক্স গো? স্ত্রী এগিয়ে আসেন
- এ্যাঁ ইয়ে... দেখি
নোমান সাহেব বাক্স খুলে দেখেন বাক্সের ভেতর আরেক বাক্সসেই বাক্সের ওপর বড় বড় করে ইংরেজিতে নানান রঙে লেখা CAMEL COLOUR BOX ডজন খানেক রঙের টিউব আর সঙ্গে গোটা কয়েক মাথা চেপ্টা তুলি
ঈদের দিন সকালে বিষণ্ন নোমান সাহেব নামাজ থেকে ফিরে এসে দেখেন তার কনিষ্ঠ পুত্র CAMEL COLOUR BOX নিয়ে বসেছে ছবি আঁকতে, দেখে মনে হচ্ছে সে একটা গরুই আঁকার চেষ্টা করছে, তবে গলাটা এত লম্বা এঁকেছে যে, মনে হচ্ছে যেন একটা উট

 মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়ন, ইসরাইলি স্বার্থ ও মার্কিন নির্বাচন

মাসুমুর রহমান খলিলী
২০১২ সালকে সম্ভবত নিকট-অতীতের সবচেয়ে আলোচিত বছরের মধ্যে গণ্য করা হবেএ বর্ষের এক-তৃতীয়াংশ এখনো বাকিসেই সময়টাও যে ঘটনাবহুল হবে, তাতে সন্দেহ নেইএ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চার বছরের জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেনমধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার মূল কেন্দ্র সিরিয়ার পরিস্থিতি একধরনের পরিণতির দিকে এগোতে পারেইরানের পারমাণবিক ইস্যু ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারেএত কিছুর পরও এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হবে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব পরিস্থিতি
একুশ শতকের একেবারে সূচনালগ্নে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ও অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে, তা পরবর্তী এক দশক বিশ্বপরিস্থিতিকে উত্তাল করে রাখেএ ঘটনার জের ধরে আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে তালেবান সরকারের পতন ঘটায়এর কয়েক বছর যেতে না যেতেই যুক্তরাষ্ট্র দখল করে ইরাকএশিয়ার কাছাকাছি দুটি অঞ্চলে বড় আকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রভাব সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেমন পড়েছে, তেমনি এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বব্যবস্থা, বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তাব্যবস্থাবিশ্বব্যবস্থার ওপরে উল্লিখিত তিনটি দিকই একটির সাথে অপরটি জড়িতমার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিরাপত্তাহীনতা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েএর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করতে হয়বিশ্বব্যাপী, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে মানবিক ও অর্থনৈতিক প্রবাহ শ্লথ হয়ে পড়েবিশ্ব অর্থনীতির বিকাশে দশকব্যাপী মন্দা নেমে আসেজীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধিতে দেশে দেশে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে
আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রতিক্রিয়াকে সহনীয় করার জন্য তাকে বিকল্প নীতি চিন্তা করতে হয়বুশের উপদেষ্টারা মনে করেন, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের মূল হুমকি মুসলিম বিশ্বের যেসব দেশ থেকে উত্থিত হচ্ছে, সেসব দেশের গণবিরোধী সরকারগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে আমেরিকার এই পররাষ্ট্রনীতি মুসলিম বিশ্বের জনমতকে প্রান্তিক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেএই প্রান্তিক চিন্তা থেকে উৎসারিত মার্কিনবিরোধী ঘৃণা ও সহিংসতা নিরসন করতে হলে আমেরিকাকে গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও যুক্তিসঙ্গত নীতিমালার পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবেএই নীতির অংশ হিসেবে আমেরিকান কংগ্রেসে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়নের প্রতি সমর্থন দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়
বুশের পরামর্শকেরা ব্যাখ্যা করেন, মার্কিনবিরোধী আলকায়েদা ও অন্যান্য প্রান্তিক সংস্থা সেসব দেশেই অধিক বিকশিত হয়েছে, যেখানে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা নেই; যেসব দেশে গণতন্ত্র, অবাধ নির্বাচন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে সেখানে মার্কিনবিরোধী সহিংসতা নেই
আমেরিকার নতুন নীতির ফলে তুরস্কে নির্বাচনের মাধ্যমে একেপি ক্ষমতায় আসার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়নিএকেপির প্রায় এক দশকের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেনিন্যাটোর সদস্য হিসেবে তুরস্ক আফগান যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেআমেরিকার গণতন্ত্রের প্রতি কার্যকর সমর্থন দেয়ার নীতির কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ কিছু সামরিক অভ্যুত্থানপ্রবণ মুসলিম দেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে পরপর ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে
একনায়কতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে তিউনিসিয়ায় আন্দোলন শুরু হলে বেন আলী সরকারকে সেনাবাহিনীর সমর্থন না দেয়ার পেছনে আমেরিকান নীতির প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের জন্যও মোবারক ও তার সহযোগীরা আমেরিকান নীতিকে দায়ী করেনইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহর ক্ষমতা হস্তান্তরেও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরলিবিয়ার বিদ্রোহীদের সামরিক সহায়তা দিয়ে গাদ্দাফির শাসনের অবসান ঘটানোতে মুখ্য ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের
গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের অবসান আর আলকায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার ব্যাপারে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ যে নীতি শুরু করেছিলেন, সে নীতির ব্যত্যয় ঘটাননি বারাক ওবামার প্রশাসনওবামার নীতির প্রধান তিনটি দিক ছিল মুসলিম বিশ্বের গণতন্ত্রায়নকে সমর্থন দেয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের সমাপ্তি টানা এবং মধ্যপন্থী ইসলামি ধারার সাথে কাজ করার প্রচেষ্টাওবামার উপদেষ্টাদের বিশ্লেষণ অনুসারে মার্কিনবিরোধী ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনমতের মূল কারণ হলো দেশটির মধ্যপ্রাচ্যনীতিএ নীতিকে প্রান্তিকতা থেকে মধ্যপন্থায় আনা গেলে মার্কিন বৈরিতার অবসান ঘটতে পারে
এ নীতির অংশ হিসেবে আরব এলাকায় মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের গণতান্ত্রিক উত্থানে বাধা দেয়া হয়নি১৯৬৭ সালের সীমানাকে ভিত্তি ধরে ফিলিস্তিনের দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নেয়ার প্রস্তাবে দৃশ্যত সমর্থন দেয়া হয়
ইহুদিবাদী কট্টরপন্থী ইসরাইলিরা আমেরিকার এ নীতিকে পাল্টাতে চায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেনএ ধারার বিশ্লেষক ক্যারোলিন বি গ্লিক জেরুসালেম পোস্টে প্রকাশিত এক কলামে কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশ নিওকনজারবেটিভ বা নব্য রক্ষণশীলদের পরামর্শে সূচিত মুসলিমসমাজকে গণতন্ত্রায়নের কর্মসূচি মার্কিন প্রশাসন এগিয়ে নেয়ার যে চেষ্টা করছে, তা ব্যর্থ হয়েছেগ্লিক ওবামার অনুসৃত নীতিকে মুসলিমদের তুষ্ট করার নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এ নীতিও ব্যর্থ হয়েছেজাতিসঙ্ঘের চলমান সাধারণ অধিবেশনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার বক্তব্যে এ বার্তাটি দেয়ার চেষ্টা করেছেন পশ্চিমা নেতাদেরমুসলমানদের স্পর্শকাতর ধর্মীয় চেতনাকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য নাকুলা বাসিলের সিনেমা, ফ্রান্স ও ডেনমার্কের কার্টুন, এমনকি বেনগাজিতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে হত্যার ঘটনার সাথে এর যোগসূত্র থাকতে পারেএসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বিশ্ব মুসলিম ও খ্রিষ্টান নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব ও সঙ্ঘাত সৃষ্টির একটি চেষ্টা লক্ষ করা যায়
মজার বিষয় হলো, খ্রিষ্ট রোমান ক্যাথলিক প্রধান পোপ ষোড়শ বেনিডিক্টসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব উত্তেজনাকর সিনেমা তৈরির উদ্যোগকে সমর্থন না করে এর নিন্দা করেছেনপ্রোটেস্ট্যান্ট ধারার খ্রিষ্টান নেতাদের একই মনোভাব দেখা গেছেইভানজেলিক ধারার কিছু খ্রিষ্ট নেতাই শুধু এর ব্যতিক্রমঅন্য দিকে বিশ্বমুসলিম স্কলারদের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি ড. ইউসুফ আল-কারজাভি, মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শায়খ ও শীর্ষ তুর্কি ইসলামিক নেতা ফতুল্লাহ গুলেন নাকুলার সিনেমা ও ফ্রান্সের ঘৃণ্য কার্টুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে সহিংসতামুক্ত প্রতিবাদের মধ্যে সীমিত রাখার আহ্বান জানান তারা কেউই মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যা বা কূটনৈতিক মিশনে হামলার ঘটনাকে সমর্থন করেননিএমনকি পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে পশ্চিমের সাথে ইরানের তীব্র উত্তেজনা চললেও তেহরানে কোনো বিদেশী মিশনে হামলার ঘটনা ঘটেনি
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান, মিসরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি, তিউনিসিয়ার নেতা ড. রশিদ ঘানুশির বক্তব্য ও সরকারি নীতিমালায় সহিংসতার পরিবর্তে শান্তি ও সহাবস্থানের বক্তব্যের প্রতিফলন লক্ষ করা গেছেমিসরের প্রেসিডেন্ট ও মুসলিম ব্রাদারহুডের স্পষ্ট বক্তব্য সত্ত্বেও ঘৃণা ও সহিংসতা সৃষ্টি মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না মর্মে ড. কারজাভির এক বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা করে এবং এক সালাফি নেতা সিনেমা তৈরির সাথে যুক্ত ব্যক্তির ফাঁসি হওয়া উচিত মর্মে দেয়া বক্তব্যের উল্লেখ করে ক্যারোলিন বি গ্লিক বলেছেন, ‘এসব বক্তব্যই হলো মিসর যারা চালাচ্ছেন তাদের কথানিওকনরা একসময় যে যুক্তি দেখিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিকভাবে শাসক নির্বাচনের সুযোগ দিলে আমেরিকার প্রতি তাদের ঘৃণা থাকবে নাএখন সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছেআসলে তারা আমেরিকান নীতিকে ঘৃণা করে না, তারা আমেরিকাকে ঘৃণা করেএ ধরনের যুক্তি এখন নেতানিয়াহু ও তার অনুসারীরা অব্যাহতভাবে উচ্চারণ করে পশ্চিমের সাথে ইসলামি বিশ্বের দূরত্ব বাড়াতে চায়তারা কামনা করে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যকে দমনে রাখতে ইসরাইলকে যা খুশি করার খোলা লাইসেন্স দেয়া হোকপশ্চিমের তুলনামূলক নমনীয় নীতিকে উল্টোমুখী করে তারা আবার সঙ্ঘাত সৃষ্টি করতে চায়এ লক্ষ্যে মুসলিমদের আঘাত করে তাদের পশ্চিমা মূল্যবোধ খ্রিষ্ট চেতনার প্রতিপক্ষে দাঁড় করাতে চায়এ বিষয়টি উপলব্ধি করে ড. কারজাভি বা ফতুল্লাহ গুলেনের মতো ব্যক্তিরা ধৈর্য, সহনশীল ও যৌক্তিক আচরণের পরামর্শ দিয়েছেন মুসলমানদেরআমেরিকার পরবর্তী নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী চক্র তাদের পক্ষের লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চায় ক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই যে রিপাবলিকান মিট রমনি তাদের প্রধান পছন্দ

হজ সর্বোত্তম ইবাদত

মোশারেফ হোসেন পাটওয়ারী
হজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন দ্বারা হজ পালন করাহজ সাধনার উচ্চস্তরএর জন্য চাই সহি নিয়ত এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি নিখুঁত খাঁটি প্রেমহজ ঈমানের পরীক্ষা, ধৈর্যের পরীক্ষা, শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদতমানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি-সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্বপ্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরান ৯৭) উল্লিখিত আয়াত  থেকে তিনটি বিষয় স্পষ্টÑ প্রথমত হজ ফরজ (জীবনে একবার), দ্বিতীয়ত সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করা কুফরি আচরণতৃতীয়ত সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির ইবাদতের মোহতাজ নন
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা:-কে প্রশ্ন করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনাপ্রশ্ন করা হলো তারপর কোনটি? তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহর পথে জেহাদ করাআবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, তারপর কোনটি? উত্তরে তিনি জানালেন হজে মাবরুর অর্থাৎ মাকবুল হজ। (বুখারি, মুসলিম)আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশের এক অনুপম বিধান হজহজরত আদম ও হাওয়া আ: বেহেশত থেকে দুনিয়াতে আগমনের পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনঅত্যন্ত পেরেশান হয়ে তারা পরস্পরকে খুঁজতে থাকেন এবং গন্ধম ফল খাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাইতে থাকেনঅবশেষে আল্লাহর রহমতে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে আরাফাতের ময়দানে তাঁরা পরস্পর মিলিত হনতারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আদম সন্তানেরা প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় এসে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হনআল্লাহর দরবারে হৃদয়মন উজাড় করে গোনাহ মাফ চান, তাঁর সান্নিধ্যের আশায়, পরকালের মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করেনআল্লাহর প্রেমিক হাজিরা সাফা মারওয়ার মধ্যে সাঈ, মিনায় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানির প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম আ:, বিবি হাজেরা ও তাঁদের পুণ্যবান সন্তান হজরত ইসমাইল আ:-এর ঈমানি পরীক্ষার প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রাণপণ চেষ্টা করেন
সর্বপ্রথম হজরত আদম আ: বায়তুল্লাহ শরিফে হজ আদায় করেনক্রমান্বয়ে হজরত নূহ আ:সহ অন্য নবী রাসূলগণও বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেনকাবা ঘরের পুনর্নির্মাণের পর হজরত জিবরাইল আ: হজরত ইব্রাহিম আ:কে পবিত্র গৃহের তাওয়াফ ও হজ করার জন্য বললেনএ নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম আ: এবং হজরত ইসমাইল আ: দুজনেই তাওয়াফসহ হজের সব কাজ সমাধা করেনতারপর আল্লাহ পাক হুকুম করলেন, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও ও মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হাজ-২২:২৭)তখন হজরত ইব্রাহিম আ: একটি উঁচু স্থানে আরোহণ করে ডানে-বামে পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে হজের ঘোষণা করলেন হে লোক সকলবায়তুল্লাহ শরিফের হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছেতোমরা তোমাদের রবের আহ্বানে সাড়া দাও আহ্বানে হাজীরা  কেয়ামত পর্যন্ত সাড়া দেবেকেউ একবার সাড়া দেবে, কেউবা বহুবারতাই তো প্রতি বছর হজ মওসুমে আল্লাহর প্রেমিক লাখ লাখ হাজির পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে কাবার প্রান্তরসবার মুখেই ধ্বনিত হতে থাকেলাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইকইয়া আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজিরএ হজ দুনিয়ার লোভ-লালসা, হিংসা বিদ্বেষ, অহঙ্কার, জৈবিক মোহ সব কিছুকে ভুলে দুই খণ্ড সাদা কাফনের কাপড় পরে পরকালের সফরের এক বিশেষ নিদর্শন মাত্রএ হজ তাকওয়া, ত্যাগ, আপন পশুত্বের কোরবানি ও নবীপ্রেম পুষ্ট হজআনুষ্ঠানিকতা ও প্রাচুর্য দিয়ে ঘেরা লোক দেখানো বা আলহাজ খেতাবের অথবা নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হজে আল্লাহ ভীতি নেই, নবীপ্রেম নেই, এমন হজ মেকি, এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য পাওয়ার আশা নেইমহানবী সা: বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করে এবং যে হজে কোনো অশ্লীল কাজ ও নাফরমানি করে না, সে দেশে ফেরে (নিষ্পাপ অবস্থায়) সেই দিনের মতো, যে দিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিলেন। (মিশকাত)মূলত কাবাঘরে হজ হচ্ছে হাজীদের আপন আপন দেহঘরের প্রতি নফসের খেয়াল, খুশি ও আমিত্ব পরিত্যাগ করে আপন রবকে জাগ্রত করে তোলাআর হজের প্রতিটি আমলের মধ্য দিয়ে মৃত্যু ও পরকালের সফরের কথা হৃদয়ের আয়নায় এঁকে নেয়াএটাই হলো হজের অন্যতম তাৎপর্য ও রহস্য
সবশেষে বলতে হয়, ইব্রাহিমি ঈমান যদি থাকে কোনো মুসলমানের তাহলে আগুনকেও ফুলের বাগান বানানোর ক্ষমতা আছে মহান আল্লাহ পাকেরদোয়া করি আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেশসহ সব দেশের হাজীদের সুস্থ ও সুষ্ঠুভাবে হজ সম্পাদন করার তৌফিক দিন এবং ইব্রাহিমি ঈমানের নূরে নূরান্বিত করে দিন তাদের অন্তরযাতে হজ পরেও তারা জানমাল ও সময় ব্যয় করতে পারে দ্বীনের রাস্তায়
লেখক : সাবেক ব্যাংকার, প্রবন্ধকার