মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১২

মানব ঐক্যের ইশতেহার মদিনা সনদ মোহাম্মদ আবুসালেহ সেকেন্দার

মহানবী সা. ধর্ম-বর্ণ, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন মদীনা সনদের মাধ্যমে। তিনি যে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাণ্ডারি ছিলেন সেই রাষ্ট্রে সব মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছিল। তিনি সবার সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। এই সনদে মদিনাবাসী ইহুদি, খ্রিস্টান, মাজুসি, অগ্নিউপাসক অর্থাৎ সনদে স্বারিত সব সম্প্রদায় উম্মাহভুক্ত বলে ঘোষিত হয়। এ সনদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘তারা সবাই মিলে সব জাতি থেকে পৃথক একটি উম্মাহ।’ আর উম্মাহভুক্ত সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মদিনা উপত্যকায় বসবাসের অধিকার রয়েছে
মক্কাবাসী মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা. ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ইয়াসরিব (মদিনা) উপত্যকায় হিজরত করেন। তাঁর হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম আধ্যাÍিকতার পাশাপাশি রাজনীতির জগতে প্রবেশ করে। পি কে হিট্টি তার ‘হিস্ট্রি অব দি আরবস’ গ্রন্থে হিজরতকে মুহাম্মাদ সা.-এর জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে সৈয়দ আমীর আলী তাঁর ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থে এ ঘটনাকে মদিনাবাসীদের জন্য নতুন শতাব্দীর সূচনা বলে মন্তব্য করেন। প্রিয়নবী সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সমকালীন পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেন। এতে তিনি ইহুদিদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থাৎ আনসার-মুহাজির-ইহুদিসহ গোটা ইয়াসরিবের জনগণের জন্য তিনি একটি সনদ প্রণয়ন করেন। মহানবী সা. কর্তৃক ইয়াসরিব উপত্যকার সব মানুষের জন্য লিখিত এই সনদই ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা খ্যাত মদিনার সনদকে ইতিহাসবিদরা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
ইয়াসরিববাসীদের সঙ্গে স্বারিত এই সনদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সনদই হজরত মুহাম্মাদ সা.-কে নতুন প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করে। এ সনদ স্বারিত হওয়ার পর ইয়াসরিব উপত্যকার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘মদিনাতুন্নবী’ বা ‘নবীর শহর’ নাম ধারণ করে। পরবর্তীতে এ শহরই মদিনা নামেই জগৎময় পরিচিতি লাভ করে। ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘রাসূলুলাহ সা. মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র লিখে দেন এবং এতে ইহুদিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ চুক্তিতে তাদের ধর্ম এবং ধন-সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, তাদের অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় এবং তাদের ওপর কতিপয় শর্ত-শরায়েতও আরোপ করা হয়।’
প্রায় সমসাময়িক ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম রহ. তার ‘সিরাতুন্নবী সা.’ গ্রন্থে এ সনদের ৫৩টি ধারার বর্ণনা করেছেন (দ্রষ্টব্য : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের [ঢাকা : ১৯৯৪] পৃ. ১৬৩-১৭১)। তবে উইলিয়াম মন্টেগোমারি ওয়াট তার ‘মুহাম্মাদ অ্যাট মদিনা’ গ্রন্থে এই সনদের (পৃ. ২২১-২২৫) ৪৭টি ধারা উল্লেখ করেছেন। যা হোক, এ সদনের মাধ্যমেই মহানবী সা. ধর্ম-বর্ণ, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাণ্ডারি ছিলেন সেই রাষ্ট্রে সব মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছিল। তিনি সবার সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। এই সনদে মদিনাবাসী ইহুদি, খ্রিস্টান, মাজুসি, অগ্নি উপাসক অর্থাৎ সনদে স্বারিত সব সম্প্রদায় উম্মাহভুক্ত বলে ঘোষিত হয়। এ সনদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘তারা সবাই মিলে সব জাতি থেকে পৃথক একটি উম্মাহ।’ আর উম্মাহভুক্ত সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মদিনা উপত্যকায় বসবাসের অধিকার রয়েছে। এ বিষয়টি সনদের ৪৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে। এ ধারার মাধ্যমে মূলত তিনি মদিনাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষাক্ত হওয়া থেকে রা করেছেন।
তিনি মদিনা রাষ্ট্রে বসবাসকারী সবাইকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অর্র্পণ করেছেন। তিনি এ সনদের ২৫, ৩৯ ও ৪২ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিরাও যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রা করা শুধু মুসলিমদের দায়িত্ব নয় বরং রাষ্ট্রের সব নাগরিকের দায়িত্ব। শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান তার ‘ইসলাম : রাষ্ট্র ও সমাজ’ গ্রন্থে বলেন, ‘কুরাইশদের সম্ভাব্য আক্রমণ হতে মদিনা রার দায়িত্ব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মদিনার নাগরিকদের উপর অর্পণ করা হয়।’ সব নাগরিকের ওপর যেমন মদিনা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অর্পিত হয় তেমনি সব নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিধানও রাখা হয়েছে। এ সনদের ২৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘বনু নাজ্জার গোত্রের ইহুদিদের জন্য যা প্রযোজ্য বানু আউফ গোত্রের ইহুদিদের জন্যও তা-ই প্রযোজ্য।’ এ ছাড়া এই সনদের ১৬ নম্বর ধারায় ইহুদিদের মুসলিমদের ন্যায় ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লামা শিবলি নোমানি তার ‘সিরাতুন্নবী সা.’ গ্রন্থে মনে করেন ‘এ সনদের মাধ্যমে ইহুদি ও মুসলিমরা পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে’।
এই সনদে মদিনা রাষ্ট্রের সবার জন্য ন্যায্য আইন প্রচলন করা হয়। মুসলিমরা অন্যায় করলে তাদের জন্য যেমন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল তেমনি অন্য ধর্মের অনুসারীরাও যদি অপরাধ করতেন তবে তাদের জন্য সাজা পাওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে এই সনদের ২৪ ও ৪৬ নম্বর ধারা নিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার (!) মশাল উড্ডীনকারী কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেন তবে বিনীতভাবে জনাবের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, সমকালীন সময়ে মুহাম্মাদ সা. ছিলেন মদিনা রাষ্ট্রে তথা গোটা আরবে বিচারকের পদে আসীন হওয়ার মতো সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। এ ছাড়া মদিনা রাষ্ট্রে উম্মাহভুক্ত ব্যক্তিদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থ অনুসারে বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল। যেমনÑএকদা মদিনার বনু কুরাইজা গোত্রের ইহুদিরা তাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হন। তখন তারা মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে এক আবেদন করেন। এতে তারা বলেন তাদের নিজ ধর্মগ্রন্থ অনুসারে বিচার করা হোক। মহানবী সা. তাদের ওই আবেদন মঞ্জুর করেন। উপরন্তু, তারা মহানবী সা.-এর পরিবর্তে তাদের বিচারক হিসেবে তাওরাত কিতাবের পণ্ডিত হজরত সাদ বিন মুয়াজকে নিযুক্ত করার আবেদন করেন। মুহাম্মাদ সা. তাদের ওই আবেদনও গ্রহণ করেন। অর্থাৎ হজরত সাদের ওপর তাওরাত কিতাব অনুসারে ইহুদিদের বিচারের ভার অর্পিত হয়।
অন্যদিকে এই সনদে উম্মাহভুক্ত সব ধর্মের অনুসারীদের স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালনের অধিকার প্রদান করা হয়। সনদের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘ইহুদিরা তাদের ধর্ম পালন করবে আর মুসলিমরা তাদের ধর্ম পালন করবে। এই বিধান তাদের মাওয়ালিদের ওপরও প্রযোজ্য হবে।’
পরিশেষে বলা যায় যে মদিনার সনদে আইনের ভাষায় সব নাগরিককে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। মহানবী সা. নিজের অনুসারীদের বিশেষ কোন সুবিধা প্রদান না করে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিককে ধর্ম পালন, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনীতি, আইন, বিচার, অর্থনীতি তথা সব েেত্র সমান অধিকার প্রদান করেন। এ জন্যই হারুন খান শেরওয়ানি তার ‘স্টাডিজ ইন মুসলিম পলিটিক্যাল থর্টস অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গ্রন্থে বলেন, ঃযব ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ মধাব ধ পযধৎঃবৎ ড়ভ ভৎববফড়স। প্রকৃতপে মহানবী সা. নিজ ধর্ম বা সংস্কৃতিকে অন্য কোন ধর্মানুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেননি। তিনি সব ধর্মের মানুষকে ন্যায্য অধিকার প্রদান করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। আধুনিককালের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ‘বাতিঘর’ আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালিতে যখন মুসলিম নারীদের হিজাব পরার কারণে শিা গ্রহণ বা চাকরি করা বন্ধ হয়ে যায়, অথবা মুসলিম হওয়ার জন্য কাউকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়; অথবা আমেরিকা, ফ্রান্স ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে রাসূল সা.কে কটা করা হয় তখন ১ হাজার ৪০০ বছর আগের মহানবী সা.-এর রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের নতুন আলোর পথ দেখায়। অন্য ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে মহানবী সা.-এর মদিনা রাষ্ট্রে কাউকে সামান্য আঁচড় পেতে হয়েছে এমন নজির নেই, যা ঐতিহাসিক সত্য। তাই বলা যায়, মহানবী সা. প্রবর্তিত মদিনার সনদ ও এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের চেতনা আধুনিক চেতনার শ্লোগানধারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মনে হয়।

 লেখক: শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন